দ্বাদশ শ্রেণির ইতিহাসের বড়ো প্রশ্ন উত্তর|class 12 history brought questions answer| class 12 history suggetion 2023 - Fresh Gk Bangla

Breaking

Tuesday, December 6, 2022

দ্বাদশ শ্রেণির ইতিহাসের বড়ো প্রশ্ন উত্তর|class 12 history brought questions answer| class 12 history suggetion 2023

 দ্বাদশ শ্রেণির ইতিহাসের বড়ো প্রশ্ন উত্তর|class 12 history brought questions answer| class 12 history suggetion 2023|





1. ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে সিরাজউদ্দৌলার সংঘাতের কারন আলোচনা করো|  পলাশীর যুদ্ধের কারণ আলোচনা কর|class 12 history brought questions answer|


দ্বাদশ শ্রেণীর ইতিহাস বিষয় থেকে যেসকল প্রশ্নগুলি উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ এখানে সেই সকল প্রশ্ন নিয়ে নোট আকারে আলোচনা করা হয়েছে। দ্বাদশ শ্রেণীর অন্যান্য বিষয়ের সকল নোট এখানে আলোচনা করা হয়। 

   


 ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে সিরাজউদ্দৌলার সংঘাতের কারণ আলোচনা করো।
অথবা,পলাশীর যুদ্ধের কারণ আলোচনা করো।



ভূমিকা :-   নবাব আলীবর্দী খাঁ -এর কোন পুত্র সন্তান ছিল না এই কারণে তিনি তার কনিষ্ঠ কন্যা আমিনা বেগম এর পুত্র 23 বছরের যুবক সিরাজউদ্দৌলাকে(1756 - 1757) তার উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করেন। সিরাজ সিংহাসনে বসায় তার আত্মীয় ঘষেটি বেগম ও সৈকত জঙ্গও মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারেননি এবং তারা সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে এমনকি ঢাকার দেওয়ান রাজবল্লভও সেই ষড়যন্ত্রে যোগদেন।

কারণ :-   সিরাজের 15 মাসের রাজত্বকালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে সংঘাতের যে সমস্ত কারণ গুলি ছিল সেগুলি হল যথা —

সিরাজের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন :-   সিরাজ সিংহাসন আরোহন করলে ওলন্দাজ ফরাসি বণিকরা এবং বাংলার জমিদাররা সিরাজকে উপঢৌকন পাঠিয়ে সম্মানিত করে। কিন্তু ইংরেজরা চিরাচরিত প্রথা উপেক্ষা করে সিরাজকে কোনো উপঢৌকন পাঠায়নি তাই সিরাজ অপমানিত বোধ করেন।

ঘষেটি বেগম ও সৈকত জঙ্গকে ইংরেজ সাহায্য :-   সিরাজের কাছে সংবাদ পৌঁছায় যে ইংরেজরা সিরাজের বিরুদ্ধে ঘষেটি বেগম ও সৈকত জঙ্গকে সাহায্য করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তাই সিরাজ ক্রুদ্ধ হন।
পলাশীর যুদ্ধের কারণ


কৃষ্ণ দাসকে আশ্রয়দান :-   রাজবল্লভ এর পুত্র কৃষ্ণ দাস ছিলেন নবাব সিরাজের শত্রু কারণ কৃষ্ণদাস প্রচুর ধনরত্নসহ ঢাকা থেকে কলকাতায় পলায়ন করলে ইংরেজ গভর্নর ড্রেক তাকে আশ্রয় দেন। নবাবের বারংবার নির্দেশ সত্ত্বেও ইংরেজরা কৃষ্ণ দাসকে নবাবের হাতে সমর্পণ করতে অস্বীকার করেন।

দুর্গ নির্মাণ :-   দাক্ষিণাত্যে যুদ্ধের অজুহাতে ফরাসি ও ইংরেজ উভয় সিরাজের অনুমতি না নিয়ে বাংলাতে দুর্গ নির্মাণ শুরু করে। সিরাজ দুর্গ নির্মাণ বন্ধ করার নির্দেশ দিলে ফরাসিরা তা পালন করে কিন্তু ইংরেজরা তার নির্দেশে কোনো কর্ণপাত করেনি এমনকি তারা দূত নারায়ন দাস কে লাঞ্ছিত করে। এর ফলে নবাবের মর্যাদা যথেষ্ট ক্ষুন্ন হয়।

দস্তকের অপব্যবহার :-   ফারুকশিয়ারের ফরমান অনুসারে 1717 খ্রিস্টাব্দে কেবলমাত্র কম্পানিই দস্তক ব্যবহার করে বাংলায় বিনাশুল্কে বাণিজ্য করার অধিকার পেয়েছিল। কিন্তু নবাবের আপত্তি সত্ত্বেও কোম্পানির কর্মচারীরা তাদের বাণিজ্যে দস্তক ব্যবহার করে,ফলে নবাব ক্রুদ্ধ হন।

উপসংহার :-   সুতরাং বলতে পারা যায় যে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ সিরাজকে সিংহাসনচ্যুত করার জন্য শুরু করে ষড়যন্ত্র।এই ষড়যন্ত্রের মূল নায়ক ছিল রবার্ট ক্লাইভ ও মীরজাফর। পরিশেষে উভয় সম্পর্কের শেষ পরিণতি হিসেবে ছিল পলাশীর যুদ্ধ। মীরজাফরের চরম বিশ্বাসঘাতকতার নবাব বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে এবং পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত হয় ও পরে বন্দি অবস্থায় মীরজাফরের পুত্র মিরনের আদেশে মুর্শিদাবাদে এনে তাকে নিহত করার সাথে সাথে ভারতের ভাগ্য কাছে স্বাধীনতার সূর্য ঘটলো।

2. অবশিল্পায়ন বলতে কী বোঝো ? উপনিবেশিক যুগে ভারতের ওপর এর কি প্রভাব পড়েছিল 
অথবা, 
অবশিল্পায়ন কি ? উপনিবেশিক আমলে ভারতে অবশিল্পায়নের ফলাফল সম্পর্কে আলোচনা করো।


ভূমিকা :- অবশিল্পায়ন শব্দটি শিল্পের অধঃপতনকে বোঝায়। শিল্পায়নের সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে তাই ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ প্রসারে সর্বাপেক্ষা বিষময় ফল হলো ভারতের চিরাচরিত ও ঐতিহ্যমন্ডিত কুটির শিল্পের ধ্বংস। অর্থনৈতিক ইতিহাসের পরিভাষায় এই অবস্থাকে অবশিল্পায়ন বলে। অবশিল্পায়নের ফলে ভারত ইংল্যান্ডের কারখানায় তৈরি পণ্যের বাজারে পরিণত হয়।


অবশিল্পায়নের ফলাফল

  অবশিল্পায়নের পর ভারতে যে সমস্ত ফলাফল লক্ষ্য করা যায় সেগুলি হল যথা —

কর্মহীনতা :- অবশিল্পায়নের ফলে ভারতের চিরাচরিত হস্তশিল্প এবং কারিগর শ্রেনী কাজ হারিয়ে বেকার সমস্যার সম্মুখীন হয়ে পড়ে এবং সেই বেকারত্ব থেকে মুক্তির জন্য তাদের পৈত্রিক কাজ ছেড়ে অন্য জীবিকা গ্রহণ করে।

কুটির শিল্পের ধ্বংসসাধন :- অবশিল্পায়নের ফলে কুটির শিল্প ধ্বংসসাধন হয় যন্ত্রচালিত কলকারখানা গড়ে ওঠে। কিন্তু ভারতে তা না ঘটায় কুটির শিল্পীরা চরম দূর্দশার মুখে পড়ে।

নগরজীবনের অবক্ষয় :- অবশিল্পায়নের ফলে ভারতের প্রাচীন ও সমৃদ্ধ শহরগুলির অবক্ষয় শুরু হয়। অষ্টাদশ শতকে ঢাকা,মুর্শিদাবাদ,সুরাট,মুসলিম পট্টম, তাঞ্জোর প্রভৃতি ছিল শিল্পসমৃদ্ধ ঘনবসতিপূর্ণ নগর। শিল্প-বাণিজ্য ধ্বংসের ফলে এসব নগর ক্রমে জনবিরল হতে থাকে এবং নগরের অক্ষবয় শুরু হয়।

কাঁচামাল সরবরাহের দেশ :- অবশিল্পায়নের ফলে ভারত বর্ষ একটি কাঁচামাল রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়। এখানকার কাঁচামাল সস্তায় ক্রয় করে ইংরেজ বণিকরা ইংল্যান্ডের রপ্তানি করতে থাকে। যার ফলে ভারত থেকে কাচা রেশম, নীল,কাঁচা,তুলা প্রভৃতি কাঁচামাল সংগ্রহ করে মুনাফার শীর্ষে পৌঁছায়।

কৃষির ওপর চাপ বৃদ্ধি :- অবশিল্পায়নের ফলে কর্মহীন শিল্পী ও কারিগররা কাজ হারিয়ে বিকল্প কর্মসংস্থান হিসেবে কৃষিক্ষেত্রে ভিড় জমায়। যার ফলে কৃষি জমির অনুপাত মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার ফলে তাদের জীবিকা নির্বাহের প্রচন্ড দুর্দশা দেখা দেয়। ফলে দেশে কৃষিজীবী ভূমিহীন কৃষকদের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পায়।

গ্রামীণ অর্থনীতিতে ভাঙ্গন :- অবশিল্পায়নের ফলে ভারতের গ্রামীণ অর্থনীতি ভেঙে পড়ে। যার ফলে গ্রামগুলির দরিদ্রতা বৃদ্ধি পেলে সেখানে অর্থনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত হয়ে প্রাণে বেঁচে থাকার তাগিদে কৃষিকে ঘৃণার ছলে মনেপ্রাণে বেছে নিয়ে বিশাল বহুল জীবন থেকে ন্যূনতম জীবনকে পাথেয় করে নেয়।

দরিদ্রতা বৃদ্ধি :- শিল্প-বাণিজ্য ধ্বংসের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি ধ্বংস হলে ভারত একটি দরিদ্র দেশে পরিণত হয়। অবশিল্পায়নের ফলে একদিকে যেমন ভারতের অর্থনীতি রক্তশূন্য হয়ে পড়ে অন্যদিকে তেমনি দরিদ্রতা বৃদ্ধি পায় তাই দারিদ্র্য,দুর্ভিক্ষ ও মহামারী ভারতীয় জীবনের নিত্য সঙ্গী হয়ে পড়ে।

উপসংহার :- পরিশেষে বলা যায় যে অবশিল্পায়নকে অনেক ঐতিহাসিকও গবেষকরা সমালোচনা করে অলীক কল্পনা করে আখ্যা দিয়েছেন। ডাক্তার বিপিনচন্দ্র ও তপন রায় চৌধুরী প্রমূখ মনে করেন অবশিল্পায়ন একটি বাস্তব ঘটনা যা ভারতবাসীকে দুঃখ-দুর্দশার অতল গহবরে নিক্ষেপ করেছিল।

3. চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্পর্কে আলোচনা করো। এর ফলাফল কি ছিল ?


ভূমিকা :- ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তারের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে থাকে। লর্ড ক্লাইভ দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা চালু করলে সারা বাংলা জুড়ে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় ফলে 1772 সালে দ্বৈত শাসন ব্যবস্থার অবসান ঘটানো হয় এবং ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা থেকে স্থায়ী আয় সুনিশ্চিত করতে লর্ড কর্নওয়ালিস 1793 সালে 22 শে মার্চ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন।


শর্তাবলী :- চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের যে সমস্ত শর্তাবলী গুলি আছে সেগুলি হল,যথা —

১) চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত অনুসারে জমিদাররা স্থায়ীভাবে জমির মালিকানা ভোগ করার অধিকার পায়।
২) নির্দিষ্ট দিনের সূর্য অস্ত যাবার আগে জমিদারকে খাজনা প্রদান করতে হতো তা না হলে তার জমিদারি বাজেয়াপ্ত করা হতো। একে বলা হত সূর্যাস্ত আইন
৩) কোন অবস্থাতেই রাজস্ব মুকুব বা পরিবর্তন করা হবে না।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত


৪) জমিদারদের দ্বারা আদায় করা রাজস্বের 9/10 ভাগ সরাসরি কোষাগারে জমা দিতে হতো।

   চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথম পরীক্ষামূলক ভাবে বাংলা,বিহার ও ওড়িশাতে চালু করা হয়। ধীরে ধীরে তা অন্যান্য অঞ্চলেও ছড়িয়ে দেওয়া হয় কোম্পানির একটি আয় সূত্র গড়ে উঠবে এই আশায়।


চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলাফল


   তবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলাফল সম্পর্কে ঐতিহাসিকরা পরস্পর বিরোধী মত প্রকাশ করেছেন। মার্শম্যান এটিকে একটি সাহসী ও বিচক্ষণ পদক্ষেপ বলে বর্ণনা করেছেন,অন্যদিকে হোমস এই ব্যবস্থাকে একটি দুঃখজনক ভ্রান্তি বলে বর্ণনা করেছেন। তাই এই ফলাফলকে দুই দিক থেকে আলোচনা করা যেতে পারে যেমন—

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফল

 চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের যে সমস্ত সুফল গুলি আছে সেগুলি হল যথা —

বাৎসরিক আয়ের হিসাব :- স্থায়ী রাজস্বের পরিমাণ নির্দিষ্ট হওয়াই সরকারের বাৎসরিক আয় ও বাজেট সঠিক করা সম্ভব।
গ্রামীণ উন্নতি :- ব্রিটিশদের এই প্রথায় জমিদাররা নিযুক্ত হয়ে গ্রামের উন্নতির ক্ষেত্রে অনেক বিদ্যালয়,চিকিৎসালয়,রাস্তাঘাট,নির্মাণ করে।
কৃষি সম্প্রসারণ :- জমির ওপর জমিদারদের শর্ত দান করাই তারা কৃষি ব্যবস্থায় বেশি করে মূলধন বিনিয়োগ করে কৃষির উন্নতি ঘটায়।
ব্রিটিশের অনুগত :- এই ব্যবস্থার ফলে জমিদার শ্রেণীর অস্তিত্ব ব্রিটিশের অনুগত ও নির্ভরশীল হয়ে ওঠে।


চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কুফল

 চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের যে সমস্ত কুফল গুলি আছে সেগুলি হল যথা —

১) এই ব্যবস্থায় জমি জরিপ না করে রাজস্ব ধার্য করা হতো ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজস্বের হার বেশি হয়ে যায়।
২) এই বন্দোবস্তের চুক্তি হয়েছিল কোম্পানির সাথে জমিদারদের এখানে কৃষকদের স্বার্থ রক্ষার কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। ফলে কৃষকদের ভাগ্য সম্পূর্ণ নির্ভর করত জমিদারদের ইচ্ছার ওপর।
৩) চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে জমিদারদের আয় বৃদ্ধি পেলেও কোম্পানির আয় সেভাবে বৃদ্ধি পায়নি ফলে কোম্পানি ভূমি রাজস্ব নিয়ে নতুন করে চিন্তা ভাবনা করতে থাকে।
৪) চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা ছিল সূর্যাস্ত আইন অর্থাৎ নির্দিষ্ট দিনে সূর্য অস্ত যাবার আগে জমিদারকে ইংরেজদের কাছে রাজস্ব প্রদান করতে হতো আর সময়মত রাজস্ব জমা না দিতে পারলে জমিদারি বাজেয়াপ্ত করা হতো। আইনের কবলে পড়ে বহু বনেদি জমিদার তাদের জমি হারায়।
৫) 1799 সালে রেগুলেশন আইন জারি করে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে জমিদারদের কৃষকদেরকে জমি থেকে উৎখাত করার অধিকার দেওয়া হয়। ফলে খুব সামান্য কারণেই জমিদাররা কৃষককে তাদের জমি থেকে উৎখাত করতে পারত।

উপসংহার :- পরিশেষে বলা যায় যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফল গুলি শুধুমাত্র ইংরেজদের জন্যই ছিল। অন্যদিকে,এর কুফল গুলি পরেছিল ভারতীয় জনসমাজের উপর। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে ভারতীয় কৃষকদের কোন দুঃখমোচন হয়নি বরং তাদের দুঃখ বেড়েছিল তাই সিরাজুল ইসলাম চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে ব্রিটিশ ভারতের প্রথম কালাকানুন বলে বর্ণনা করেছেন।

4. ভারতের নবজাগরণে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান আলোচনা করো।
অথবা,
উনবিংশ শতাব্দীর ভারতবর্ষে শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা উল্লেখ করো।


ভূমিকা :- আধুনিক ভারতে যেসব সংস্কারক জন্মগ্রহণ করেছিল তাদের মধ্যে সবচেয়ে অন্যতম ছিলেন রাজা রামমোহন রায় (1772 — 1833 খ্রিস্টাব্দ)। তাকে ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ বা আধুনিক ভারতের জনক নানা আখ্যায় অভিহিত করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কাকে ভারত পথিক বলে সম্মান জানিয়েছেন। পন্ডিত জহরলাল নেহেরুর মতে তিনি হলেন ভারতের জাতীয়তাবাদের জনক। তাই আমাদের সাহিত্য, ধর্ম, শিক্ষা বিজ্ঞান,সমাজনীতি,রাষ্ট্রনীতি যাকে আমরা আধুনিক বলি না কেন রাজা রামমোহন হলেন তার অগ্রদূত।

বহুমুখী প্রতিভা :- 1772 খ্রিস্টাব্দের 22 মে হুগলি জেলার রাধানগর গ্রামে এক ধনী রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ পরিবারে তাঁর জন্ম হয়। অসাধারণ ধীশক্তি ও প্রতিভা বলে খুব অল্প বয়সে তিনি আরবি ফারসি ও সংস্কৃত ভাষায় এবং হিন্দু,মুসলিম, বৌদ্ধ,খ্রিস্টান বিভিন্ন ধর্ম শাস্ত্রে অসাধারণ পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ দ্বারা তিনি গভীরভাবে প্রভাবিত হন। তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সমন্বয়ে নবভারত গঠনের আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন।

ধর্ম সংস্কার :- বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ পাঠের ফলে তিনি একেশ্বরবাদী নিরাকার ব্রাহ্মণ বাদের সমর্থক হয়ে ওঠেন। তিনি বেদ,উপনিষদ প্রভৃতি গ্রন্থ ব্যাখ্যা করে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে পৌত্তলিকতা, পুরোহিততন্ত্র,মূর্তিপূজা,লোকাচার হিন্দু ধর্মের মূল কথা নয়। 1803 খ্রিস্টাব্দে বহুদেববাদের বিরুদ্ধে এবং এক ঈশ্বর বাদের সমর্থনে ফরাসি ভাষায় তিনি একটি পুস্তিকা রচনা করেন তার নাম ‘তুহাৎ-উল-মুয়াহিদ্দিন'। কেবলমাত্র তাই নয় তিনি বাংলা ভাষায় বেদান্তের ভাষ্য রচনা করেন এবং ইস,কট,কেন,মন্ডুক,মান্ডুক্য এই পাঁচটি উপনিষদের বাংলা অনুবাদ করেন। 1815 খ্রিস্টাব্দে তিনি কলকাতায় তার বন্ধু ও তার অনুগামীদের নিয়ে আত্মীয় সভা স্থাপন করেন। এমনকি 1828 খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মসমাজ স্থাপন করেন।

সমাজ সংস্কারক :-  রামমোহন সমাজ মুক্ত যুক্তিবাদী হিন্দু সমাজে প্রচলিত বাল্যবিবাহবহুবিবাহ প্রভৃতি সামাজিক কুপ্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন। এগুলি নিবারণের জন্য তিনি সংবাদপত্রের মাধ্যমে প্রতিবাদে সচ্চার হন। 1818 খ্রিস্টাব্দে সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে শুরু করেন এবং জনমত গঠনে ব্রতী হন। রামমোহন রায়ের সক্রিয় সমর্থন ও সহযোগিতায় শেষপর্যন্ত গভর্নর জেনারেল বেন্টিং 1829 খ্রিস্টাব্দে 4 ঠা ডিসেম্বর এক আইনের মাধ্যমে সতীদাহ প্রথাকে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করেন।

শিক্ষা সংস্কার :-  তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারে একজন উৎসাহী সমর্থক ছিলেন। তিনি মনে করতেন যে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার ওপর ভিত্তি করে নবজাগরণ গড়ে উঠবে। ডেভিড হেয়ারের বিদ্যালয় ও রামমোহনের প্রতিষ্ঠিত বেদান্ত কলেজে পাশ্চাত্য, সমাজ বিজ্ঞান ও পদার্থবিদ্যার শিক্ষা দেওয়া হতো। 1823 খ্রিস্টাব্দে লর্ড আমহার্স্টকে লিখিত এক পত্রের মাধ্যমে তিনি ভারতবর্ষে গণিত,প্রকৃতিক বিজ্ঞান,রসায়ন প্রভৃতি শিক্ষার দাবি জানান।

সংবাদপত্রের প্রকাশনা :- রামমোহন ছিলেন ভারতীয় সাংবাদিকতার অগ্রদূত। তিনি বাংলা,ইংরেজি ও ফারসি ভাষায় বেশ কয়েকটি সংবাদপত্র প্রকাশ করেন। এগুলির মধ্যে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত সংবাদ কৌমুদী ছিল উল্লেখযোগ্য এবং ফারসি ভাষায় উল্লেখযোগ্য ছিল ‘মীরার-উল-আখরার'


মূল্যায়ন :-  পরিশেষে বলা যায় যে রামমোহন এর কৃতিত্ব নিয়ে বিভিন্ন মতামত থাকলেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রামমোহনকে ‘ভারত পথিক' বলে অভিহিত করেছেন,অধ্যাপক দিলীপ কুমার বিশ্বাস বলেছেন ‘বিশ্বপথিক', ডক্টর স্পিয়ার তাকে ‘আধুনিক ভারতের স্রষ্টা' বলে অভিহিত করেছেন, ডক্টর বিপিনচন্দ্র বলেছেন ‘উনিশ শতকে ভারতের গগনে রামমোহন রায় উজ্জ্বলতর নক্ষত্র রূপে ভাস্কর ছিলেন’। তাই রাজা রামমোহন রায়কে অসাধারণ শক্তি ও প্রতিবাদের অধিকারের জন্য আমরা তাকে ভারতের নব যুগের প্রবর্তক,আলোর দিশারী, প্রদীপ্ত প্রমিথিউস নানান ভাবে অভিহিত করে থাকি।

5. ভারতে রেলপথ স্থাপনের উদ্দেশ্য কি ছিল ? ভারতীয় অর্থনীতিতে রেলপথের প্রভাব আলোচনা করো।


ভূমিকা :- 19 শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ভারতবাসীর অর্থনৈতিক জীবনে যেসব পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছিল তার মধ্যে রেলপথ ছিল অন্যতম নিয়ন্ত্রক। 1853 সালে লর্ড ডালহৌসির আমলে বোম্বাই থেকে থানেশ্বর পর্যন্ত রেল পথ তৈরি করেছিল। এই রেলপথ তৈরির দায়িত্ব পড়েছিল গ্রেট ইন্ডিয়ান পেনিনসুলার কোম্পানির হাতে। লর্ড ডালহৌসি রেলপথ স্থাপনের মাধ্যমে ভারতে অর্থনৈতিক,প্রশাসনিক সামরিক স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে এ দেশে রেলপথ স্থাপনে উদ্যোগী হয়েছিল।

ভারতে রেলপথ স্থাপনের উদ্দেশ্য

    রেলপথ স্থাপনের যে সমস্ত উদ্দেশ্যগুলি আছে সেগুলি হল যথা —

সরকারি উদ্দেশ্য :- ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক উন্নতিকে জলাঞ্জলি দিয়ে ইংরেজরা সম্পূর্ণভাবে নিজস্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে ভারতে রেলপথ স্থাপনের উদ্যোগী হয়েছিল। লর্ড ডালহৌসির উদ্দেশ্যে ভারতের প্রত্যন্ত ইংরেজ সেনাবাহিনী দ্রুত পৌঁছে দেওয়া,শিল্প বৃদ্ধি করা,দূরবর্তী অঞ্চল থেকে মালপত্র আমদানি করার জন্য রেলপথ স্থাপন করেন।

অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য :- অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল ভারতের রেলপথ নির্মাণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য। ভারত থেকে কাঁচামাল সংগ্রহের জন্য রেল ব্যবস্থা অতি প্রয়োজনীয় ছিল। এছাড়াও ইংরেজরা মনে করেন যে রেলপথের বিস্তার হলে সেখানে বহু ইংরেজদের কর্মসংস্থানের সুযোগ মিলবে।

রাজনৈতিক ও সামরিক উদ্দেশ্য :- রাজনৈতিক প্রয়োজনে রেলপথ প্রবর্তনের প্রয়োজনীয়তা দেখা যায়। বিশাল ভারতবর্ষে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাজে দ্রুত যোগাযোগের জন্য ইংরেজরা রেল ব্যবস্থা চালু করেছিল। এছাড়াও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের ব্রিটিশ বিরোধী আইন দমন করতে,বহিঃশক্তির আক্রমণ,দুর্ভিক্ষের সময় সেনাবাহিনীর ত্রাণ,খাদ্য ও রসদ দেবার জন্য ব্রিটিশ সরকার রেলপথ স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেছেন।

ভারতীয় অর্থনীতিতে রেলপথের প্রভাব 


 ভারতীয় অর্থনীতিতে রেলপথের প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে রেলপথের প্রচলন ঘটে ছিল যা ভারতীয় অর্থনীতিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করে। এই সময় থেকে ভারতের যে স্থানে ব্রিটিশ মূলধন বিনিয়োগ হতে শুরু করে রেলপথ হল তাদের মধ্যে অন্যতম পাথেয়।

সুফল :-
     ভারতীয় অর্থনীতিতে রেলপথের যে সমস্ত সুফল দিক গুলি আছে সেগুলি হল যথা —

পরিবহন ব্যবস্থার পরিবর্তন :- রেলপথ প্রবর্তনের ফলে ভারতে চিরাচরিতভাবে পরিবহন ব্যবস্থার এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে। এরপূর্বে পরিচালিত সড়ক ও নৌকা ছিল ব্যয়বহুল, সময়সাপেক্ষ ও বিপদজনক। তাই রেল ব্যবস্থার ফলে যোগাযোগব্যবস্থা দ্রুত,নিরাপদ ও সহজ হয়।

বাণিজ্যের প্রসার :- রেলপথ ভারতীয় অর্থনীতিতে পণ্য আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে পরিবর্তনের সূচনা ঘটায়। যার ফলে রেলপথ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। এছাড়াও রেলপথ ধরে গ্রামগঞ্জে বিপন্ন বিলাতি পণ্য ঢুকে যায়।

আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে যোগাযোগ :- পূর্বে কৃষি ছিল আঞ্চলিক ও প্রয়োজনভিত্তিক। কিন্তু রেলপথ স্থাপনের ফলে ভারতীয় কৃষি পণ্যকে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সংযুক্ত করে কৃষিকে বেশি মাত্রায় বাণিজ্য পণ্য ও অর্থ ব্যয় পণ্য উৎপাদনের আগ্রহী করে তোলে।

রপ্তানি আমদানি বৃদ্ধি :- পূর্বে কৃষিপণ্য খুব সামান্যই বাইরে রপ্তানি করা হতো। কিন্তু রেলপথের মাধ্যমে যোগাযোগের ফলে বিদেশে ভারতীয় পণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধি পায়। গম,চাল, চামড়া,তেল,বীজ প্রভৃতি বিদেশে পাঠিয়ে এবং শিল্পজাত বস্তু দেশে এনে অর্থনৈতিক বাজার চাঙ্গা করে তোলে।

কর্মসংস্থান :- রেলপথ নির্মাণের ফলে ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভূমিহীন কৃষক অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে রেলে নিযুক্ত হয়ে তাদের রুটি-রোজগারের ঠিকানা খুঁজে পায়। এছাড়াও রেলপথের মাধ্যমে বৈদেশিক বাণিজ্য বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য বন্দর এলাকায় কর্মসংস্থান ও জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়।


কুফল :-
 বেশকিছু উপকারিতা থাকা সত্ত্বেও এ দেশে রেলপথ প্রবর্তন এর কিছু অকল্যাণকর দীর্ঘ ছিল, সেগুলি হল —

১) ভারতীয় সম্পদের বহির্গমন ও নিষ্কাশন এর জন্য রেলপথ বহুলাংশে দায়ী ছিল। তাই রেলে পুঁজি বিনিয়োগ করে ব্রিটিশ শিল্পপতিরা গ্যারান্টি প্রথার মাধ্যমে ভারতীয় অর্থকে শোষণ করে ব্রিটেনে নিয়ে যায় যার ফলে গ্রামীণ অর্থনীতি রক্তশূন্য হয়ে পড়ে।

২) রেল যোগাযোগের ফলে ইংল্যান্ড জাতীয় পণ্যাদির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় না পেরে ভারতীয় কুটির শিল্প ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। রেলে অধিকাংশ শ্রমিকের কর্মসংস্থান হলেও অন্যান্য পরিবহন সংস্থার শ্রমিকদের কাজের সুযোগ কমে যায়।


6. সমাজ সংস্কারক হিসেবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান আলোচনা করো।


ভূমিকা :-  উনিশ শতকে সমাজ সংস্কারক হিসেবে ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এর নাম বিশেষ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে হয়। তার কাছে মানুষই ছিল মুখ্য তাই মানুষের মুক্তির জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন। সাদা ধুতি,চাদর ও চটি পরিচিত এই তেজস্বী ব্রাহ্মণ এর মধ্যে নবজাগরণের প্রবল যুক্তিবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার এক অপূর্ব প্রভাব ঘটেছিল। এই কারণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে — এই ভীরুর দেশে তিনিই ছিলেন একমাত্র পুরুষ সিংহ।

শিক্ষা সংস্কার :- 1851 খ্রিস্টাব্দে সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হয়ে তিনি শিক্ষা এবং সংস্কারের কাজে ব্রতী হন। পূর্বে কেবলমাত্র ব্রাহ্মণ ও বৌদ্ধ পরিবারের সন্তানরা সংস্কৃত কলেজের ছাত্র হতে পারত। বিদ্যাসাগর এই প্রথা রদ করে সকল বর্ণের ছাত্রদের জন্য সংস্কৃত কলেজের পড়াশোনার পথ উন্মুক্ত করেন।

শিক্ষার বিস্তার :-  জনশিক্ষা বিস্তারের কাজেও তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। তিনি উপলব্ধি করেন যে শিক্ষার অচলাবস্থা দূর করে মানুষকে প্রকৃত মনুষত্বে পৌঁছে দিতে হবে। তিনি শিক্ষা বিস্তারের জন্য বাংলার বিভিন্ন গ্রামে ও বিভিন্ন অঞ্চলে 33 টি স্থায়ী ও 20 টি মডেল স্কুল বা আদর্শ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এগুলির মধ্যে অনেকগুলি তিনি নিজেই প্রায় চালাতে।

নারী শিক্ষা :- পূর্বে পর্দার আড়াল থেকে নারী সমাজের মুক্তির জন্য তিনি হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। সেগুলিতে 1300 ছাত্রী পড়াশোনা করত। তার অন্যতম কৃতিত্ব ছিল ‘মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন’,এখানে বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনা হত।

বিধবা বিবাহ :- বহু বিবাহ,বাল্য বিবাহ এবং বিধবা বিবাহ রোধ এর জন্য তিনি আন্দোলনে নামেন। 1855 সালে বিধবা বিবাহ প্রচলিত কিনা সে সম্পর্কে দুটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। বিধবা বিবাহ আইন পাস করার জন্য 1000 ব্যক্তির স্বাক্ষর নিয়ে একটি আবেদনপত্র ব্রিটিশ সরকারের কাছে পাঠান। 1856 সালে লর্ড ডালহৌসি বিধবা বিবাহ আইন পাস করে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নিজপুত্রকে এক বিধবা পাত্রী সাথে বিবাহ দেন।

বহুবিবাহ :- হিন্দু সমাজে বহুবিবাহের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। 1855 সালে তিনি বহুবিবাহ প্রথা নিষিদ্ধ করার জন্য অনুমতি জানিয়ে 50 হাজার মানুষের স্বাক্ষর সম্বলিত এক আবেদনপত্র সরকারের কাছে পাঠান।

বাল্যবিবাহের বিরোধিতা :- তৎকালীন হিন্দু সমাজে বাল্যবিবাহ এক অভিশাপের মোচন। এই অভিশাপ মোচনের জন্য আজীবন বাল্যবিবাহের বিরোধিতা করেন বিদ্যাসাগর। ‘সর্বশুভকরী’ পত্রিকায় প্রথম বাল্যবিবাহের দোষ নামক প্রবন্ধ লেখেন তিনি। বাল্যবিবাহের ফলে মেয়েরা খুব অল্প বয়সে বিধবা হতো বলে বাকি জীবন দুঃখ কষ্টে বিভিন্ন গালিগালাজ ও কঠোর অনুশাসন এর মধ্যে কাটাতে হতো। তাই এই অল্প বয়সী মেয়েদের জীবনে দুঃখ মোচনের জন্য বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহের প্রচলন করতে চেয়ে ছিলেন। তার ফলশ্রুতি রূপে ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে এক আইন পাস করে মেয়েদের বিয়ের বয়স 10 বছর ধার্য করেন।


মূল্যায়ন :- সুতরাং,পরিশেষে বলা যায় যে বিদ্যাসাগর রামমোহন রায়ের মতো বিতর্ক পুরুষ না হলেও তার অবদানের মূল্যায়ন যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। তাই বিভিন্ন পন্ডিত বিভিন্ন কারণে বিধবা বিবাহ ও সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনে সাফল্য হলেও বিধবা বিবাহের পক্ষে আন্দোলনটি তেমন কোনো সাফল্য লাভ করেনি। কিন্তু এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে নারী মুক্তির বিষয়টি সমস্ত ভারতের চিন্তাশীল সমাজকে বিশেষভাবে আলোড়িত করেছে।

7. নৌ-বিদ্রোহ সম্পর্কে আলোচনা করো।


ভূমিকা :- ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে একটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা হলো নৌ-বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহের প্রবল আঘাত ব্রিটিশ শক্তিকে ভারতবর্ষ ছেড়ে যেতে বাধ্য করেছিল। তাই 1857 সালের সিপাহী বিদ্রোহকে যদি ভারতের স্বাধীনতার প্রথম যুদ্ধ বলে মনে করা হয়, তাহলে 1946 সালের বিদ্রোহকে ভারতের স্বাধীনতার শেষ যুদ্ধ বলে আমরা চিহ্নিত করতে পারি।


নৌ বিদ্রোহের উৎস

1946 সালের 18 ফেব্রুয়ারি তারিখে নৌ-বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল। এই বিদ্রোহের অন্যতম কারণ ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন নৌবাহিনীর জন্য বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা হয় এই সংগৃহীত সৈন্যগণ আজাধীন ফৌজ এর বিচারের নামে প্রহসনের ঘটনার তারা দারুন ভাবে প্রবাবিত হয়। নৌ-নাবিক ফণীভূষণের মতে ভারতের সমাজতান্ত্রিক দলের সিদ্ধান্ত সেনাবাহিনীর ওপর গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল এবং নৌ সেনাদের বিদ্রোহের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিল। এমত অবস্থায় ‘রয়েল ইন্ডিয়ান নেভির তলোয়ার’ নামক জাহাজ নিম্নমানের খাদ্য ও জাতীয় অবমাননার প্রতিবাদে নৌ-সেনারা 1946 সালের 18 ফেব্রুয়ারি তারিখে ধর্মঘট শুরু করে।

নৌ বিদ্রোহের সূচনা

 নৌবাহিনীর এই ধর্মঘটে 15 হাজার শ্রমিক যোগ দেয়। পরের দিন 19 শে ফেব্রুয়ারি তারিখে নৌ-বিদ্রোহীরা ব্রিটিশ পতাকা নামিয়ে কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ও কমিউনিস্টদের পতাকা উত্তোলন করে। তাদের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল ‘ভারত মাতা জিন্দাবাদ’,‘ইংরেজ ভারতছাড়ো’,‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক’ প্রভৃতি স্লোগান। নৌ বিদ্রোহীরা এস.এন.রয় -কে সভাপতি এবং মানসিংহকে সহ-সভাপতি হিসেবে নিযুক্ত করেন। বোম্বাইয়ের সমস্ত রণতরী এবং বারোটি জাহাজের সমস্ত নাবিক নৌ-বিদ্রোহে যোগ দেয়।


নৌ বিদ্রোহের গতি প্রকৃতি

 ধীরে ধীরে নৌবিদ্রোহ বোম্বাই থেকে মাদ্রাস ও কলকাতা বন্দরের ছড়িয়ে পড়ে। বোম্বাই বন্দর এর সমস্ত জাহাজে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। ব্রিটিশ সরকার বিদ্রোহীদের দমন করার জন্য পদাতিক বাহিনী প্রেরণ করে এর ফলে পদাতিক বাহিনী ও নৌবাহিনীর মধ্যে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। সাত দিনব্যাপী এই যুদ্ধের পর ভারতীয় সেনারা জয়লাভ করে। নৌ সেনাদের জয়লাভে ব্রিটিশ সরকার ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ অ্যাডমিরাল গডফ্রে বোমারু বিমানের চেপে ঘটনাস্থলে এসে বিদ্রোহীদের ধ্বংস করার হুঁশিয়ারি দেন কিন্তু নৌ-সেনারা তাতে ভয় না পেয়ে তাদের আন্দোলনকে বরং আরও জোরদার করতে উদ্যোগী হয়।

    নৌ বিদ্রোহের তাদের বিদ্রোহকে সমর্থন করার জন্য ভারতের সমস্ত রাজনৈতিক দলকে আহ্বান জানান। তাদের আহবানে সাড়া দিয়ে বোম্বাইয়ের কমিউনিস্ট পার্টি ধর্মঘটের ডাক দেয়। এই ধর্মঘটে 23 হাজার শ্রমিক অংশগ্রহণ করে,পুলিশের সাথে জনতার সংঘর্ষ বাধে। এ সময় বিদ্রোহীরা দাবি করেন যে ভারতের আজাধীন ফৌজ এর বিচার স্থগিত রাখতে হবে এবং অন্যদিকে ইন্দোনেশিয়া থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে তারা তাদের বেতন বৃদ্ধির দাবিও তুলে ধরে।

নৌ বিদ্রোহের পরিণতি

 নৌ বিদ্রোহ ক্রমশ বেপরোয়া হয়ে উঠতে থাকলে অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেল  নৌবিদ্রোহীদের আত্মসমর্পণের কথা বলেন এবং এই আশ্বাস দেন যে তাদের বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষ থেকে বলপ্রয়োগ মূলক ব্যবস্থা নেওয়া হলে জাতীয় কংগ্রেস তাদের স্বার্থ রক্ষার যথাসাধ্য চেষ্টা করবে। অন্যদিকে গান্ধীজী বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে বিরূপ মন্তব্য করে বলেন যে নৌবাহিনী চাকরি না পোষালে তারা যেন চাকরী ছেড়ে দেয়। এই বক্তব্যে নৌবাহিনী অত্যন্ত ব্যথিত হয় এবং অবশেষে বল্লভ ভাই প্যাটেলের কথায় আশ্বস্ত হয়ে তারা আত্মসমর্পণ করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং বলেন যে ‘আমরা ভারতবাসীর কাছে আত্মসমর্পণ করছে ব্রিটিশদের কাছে নয়।

     নো বিদ্রোহীরা আত্মসমর্পণ করলে ব্রিটিশদের যুদ্ধজাহাজ নৌবাহিনীর জাহাজ গুলিকে ঘিরে ফেলে নৌসেনাদের গ্রেফতার করে এবং তাদের ওপর অকথ্য অত্যাচার চালাতে থাকে। নৌবাহিনীদের নেতা এস.এস খানের পায়ে পাথর বেঁধে তাকে আরব সাগরে ডুবিয়ে হত্যা করা হয়। এর ফলে নৌ বিদ্রোহের করুন পরিসমাপ্তি ঘটে।

উপসংহার :- সুতরাং আমরা বলতে পারি যে নৌবিদ্রোহ ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের মনে মৃত্যুর ঘণ্টাধ্বনি বাজিয়ে দিয়েছিল,ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তিকে কম্পিত করেছিল এবং ব্রিটিশ শক্তিকে ভারত রাজ্য ছেড়ে যেতে মানসিকভাবে বাধ্য করে তুলেছিল। তাই শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার ভারতবর্ষকে স্বাধীনতা দেওয়ার পূর্ব ঘোষিত সময় 1948 সালের জুন মাসের পরিবর্তে 1947 সালের 15 আগস্ট তারিখে কমিয়ে আনতে বাধ্য হয়। এই ঘটনা থেকে ভারতের স্বাধীনতা লাভের ইতিহাসে নৌ বিদ্রোহের সুমহান তাৎপর্য সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।


8. স্যার সৈয়দ আহমেদ ও তার আলীগড় আন্দোলনের বিবরণ দাও।
অথবা, 
মুসলমান সমাজের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে আলীগড় আন্দোলনের প্রভাব আলোচনা করো।


ভূমিকা :- 19 শতকে যিনি মুসলিম সমাজের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষায় যুক্তিবাদী ভাবধারার প্রবর্তন করেছিলেন তিনি হলেন স্যার সৈয়দ আহমেদ খাঁ (1817 থেকে 1898 খ্রিস্টাব্দ)। তিনি বুঝেছিলেন ভারতে মুসলমানদের অনগ্রসরতার অন্যতম কারণ ব্রিটিশ বিদ্বেষ। মুঘল শাসনের অবসান ঘটানোর জন্য মুসলমান সমাজ ইংরেজদের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করে। এমনকি আধুনিক শিক্ষা গ্রহণ কেও ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করে। অপরদিকে,অভিজাত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর হিন্দুরা পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতি গ্রহণ করে দ্রুত উন্নতির পথে অগ্রসর হয়। এই সমস্ত কারণে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত সৈয়দ আহমেদ মুসলমান সমাজকে পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে শুরু করেন তার আলিনগর আন্দোলনের মাধ্যমে।

আলীগড় আন্দোলনের উৎপত্তি :-   সৈয়দ আহমেদ খান তখন ‘The Loyal Mohamedans’ নামক একটি গ্রন্থ রচনা করে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে মহাবিদ্রোহের সময় যত মুসলমান বিদ্রোহীরা সমর্থন করেছিলেন তার থেকে অনেক বেশি সংখ্যক মুসলমান ইংরেজ সরকারের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেছিলেন। তিনি মুসলমান সমাজকে একথা বোঝান যে ইংরেজ সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা ও ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণের ওপর তার উন্নতি একান্তভাবে নির্ভরশীল। মুসলমানদের মধ্যে পাশ্চাত্য ভাবধারা ও বৈজ্ঞানিক যুক্তি প্রসারের জন্য সৈয়দ আহমেদ যে কর্মসূচি গ্রহণ করে তা অসাধারণ ভাবে আলীগড় আন্দোলন নামে খ্যাত।

পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের প্রয়াস :-  1864 খ্রিস্টাব্দে স্যার সৈয়দ আহমেদ মাতৃভাষা উর্দুর মাধ্যমে পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রসারের জন্য ‘Sintific Socity’নামে একটি সমিতি স্থাপন করে। এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান কাজ ছিল ইংরেজি ভাষায় রচিত গ্রন্থ গুলি উর্দুতে অনুবাদ করে মুসলমানদের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারে সহায়তা করা। এই উদ্দেশ্যে স্যার সৈয়দ আহমেদ 1857 খ্রিস্টাব্দে আলিগড়ে ‘Mohamedan Anglo Oriantal Collage’ স্থাপন করেছিলেন যা পরবর্তীতে ‘আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়’ নামে পরিচিত হয়েছিল। এই কলেজে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছিল আলীগড় আন্দোলন। 1864 খ্রিস্টাব্দে তিনি গাজীপুরে একটি ইংরেজী বিদ্যালয় স্থাপন করেন।

স্যার সৈয়দ আহমেদ ও মুসলিম সমাজ সংস্কার :-   স্যার সৈয়দ আহমেদ দেশ প্রেমিক হলেও জাতীয় কংগ্রেসকে অত্যন্ত শত্রু বলে মনে করতেন। জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পর 1886 খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘Mohamadan Education Congres’ প্রতিষ্ঠা করেন। এটি পড়ে ‘Mohamadan Education Confarance’ নামে পরিচিত হয়।এরপর তিনি গঠন করেন ‘United Petrotyatie Assocaition’ (1888)। এই সংস্থার প্রধান কাজ ছিল জাতীয় কংগ্রেসের বিরোধিতা করা। এরপর তিনি স্থাপন করেন ‘Mohamadan Anglo Oriantal difrence’ (1863)। এই সংগঠনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল— (i) মুসলমানদের রাজনৈতিক অধিকার রক্ষা করা,(ii) ইংরেজ শাসন কে সমর্থন করা,(iii) ইংরেজ শাসনের প্রতি অধিকতর মুসলমানদের অনুগত সৃষ্টি করা।

   তিনি উর্দু পত্রিকা ‘তহজিব-আল- আখলাক’ ও ইংরেজি ‘পাইওনিয়ার’ পত্রিকার মাধ্যমে তার মত প্রচার করেন।

আলীগড় আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা :-  স্যার সৈয়দ আহমেদ খান মুসলমানদের মধ্যে এই আশঙ্কা প্রবেশ করিয়ে দিয়েছিলেন যে ভারতে প্রতিনিধিত্বমূলক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হলে সংখ্যাগরিষ্ঠ ও উন্নততর হিন্দুরা অধিক ক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে। 1888 খ্রিস্টাব্দে তিনি স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেন যে ভারতীয় কংগ্রেস ভারতের সকল সম্প্রদায়ের আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হতে পারে না।

অবশ্য প্রথম দিকে তিনি হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য ও সহযোগিতার কথা প্রচার করেন, তিনি বলেছিলেন যে হিন্দু ও মুসলমান দুটি চক্ষু এর একটি আঘাতপ্রাপ্ত হলে অপরটি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু ক্রমশ তিনি বিচ্ছিন্নতাবাদের প্রতি আকৃষ্ট হন তিনি হিন্দু ও মুসলমান দুটি পৃথক ও স্বতন্ত্র জাতী ও তাদের স্বার্থ পরস্পর বিরোধী এই দ্বিজাতি তত্ত্বের বীজ রোপন করেন।

আলীগড় আন্দোলনের ঐতিহাসিক গুরুত্ব :-   স্যার সৈয়দ আহমেদ অনুন্নত সমাজের নবজাগরণ এনেছিলেন এইজন্য তাকে রাজা রামমোহন রায়ের সাথে তুলনা করা হয়  তার কার্যকলাপের ফলে ভারতের রাজনীতিতে মুসলমানদের গুরুত্ব ইংরেজ সরকার ক্রমশ অনুভব করেন। দ্বিজাতি তত্ত্ব ও বিচ্ছিন্নতাবাদের প্রসারে আলিগড় কলেজের অধ্যাপক থিওডোর ব্রেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন। তিনি আলিগড় থেকে প্রকাশিত ‘ইনস্টিটিউট গেজেট’ নামে সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করেন। এতে এমন সব প্রবন্ধ হতে থাকে যার ফলে আরে আলীগড় আন্দোলন ক্রমশ সাম্প্রদায়িকতার পথে অগ্রসর হয়েছিল। এই সাম্প্রদায়িকতার ফলশ্রুতি হিসেবে ভারতবর্ষের বুক ভেদ করে পাকিস্তান নামক নতুন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়।


9. বাংলার নবজাগরণের প্রকৃতি ও সীমাবদ্ধতা লেখ।

ভূমিকা :- পাশ্চাত্য ভাবধারার প্রভাবে উনবিংশ শতকে বাংলার শিক্ষা ক্ষেত্রে যে ব্যাপক অগ্রগতি শুরু হয় তার ফলে বাংলার এক নবযুগের সূচনা হয়,এই ঘটনা বাংলার নবজাগরণ নামে পরিচিত। বাংলার নবজাগরণের দ্বারা রামমোহন রায়ের সংস্কারমূলক কর্মসূচি থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃজনশীল কাজ কর্ম পর্যন্ত অব্যাহিত থাকে। তাই উনবিংশ শতকে বাংলার নবজাগরণকে কোন ঐতিহাসিক পঞ্চদশ শতকের ইতালির নবজাগরণ এর সাথে তুলনা করেন।

বাংলার নবজাগরণের প্রকৃতি :- উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণের প্রকৃতি সম্পর্কে পণ্ডিতদের মধ্যে নানা বিতর্ক আছে সে সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হল —

বাস্তব নবজাগরণ :- উনিশ শতকে বাংলায় প্রকৃত নবজাগরণ ঘটে বলে অনেকে মনে করেন। তাই বাংলার সংস্কৃতিক ও বৈদ্ধ্যতিক জাগরণকে স্যার যদুনাথ সরকার দ্বিধাহীনভাবে রেনেসাঁস বা নবজাগরণ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন বাংলার নবজাগরণ ইতালির নব জাগরণের চেয়ে ব্যপক,গভীর ও বৈপ্লবিক। শোভন সরকার, অবলান দত্ত প্রমুখরা বাংলার জাগরনে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও এটিকে প্রকৃত নবজাগরণ বলে আখ্যা দিয়েছেন।

তথাকথিত নবজাগরণ :- সেন্সাস কমিশনার অশোক মিত্র মনে করেন এই জাগরণ শহর কলকাতার মানুষের মধ্যে আবদ্ধ ছিল তাই গ্রামীণ বাংলার জনগণকে তার স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি 1951 সালে আদমশুমারি রিপোর্ট এ বাংলার নবজাগরণকে তথাকথিত নবজাগরণ বলে আখ্যা দিয়েছেন। অন্যদিকে সুপ্রকাশ রায়,বরুণ দে, ডক্টর সুমিত সরকার প্রমুখরা বাংলার নবজাগরণকে তথাকথিত নবজাগরণ বলে স্বীকার করেন।

নবজাগরনের স্রষ্টা :- বাংলার নবজাগরণের প্রকৃতি স্রষ্টা কারা তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্ক আছে। বাংলার নবজাগরণে স্রষ্টা রামমোহন রায় বা ডিরোজিও যেকোনো কর্তৃককে মার্কিন গবেষক ডেভিড এ কথা অস্বীকার করেন। কিন্তু এই অভিমত যথার্থ নয়। তাই ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার এর মতে পাশ্চাত্য সভ্যতার সমন্বয়ে ভারতবাসীর অন্তরে নবজাগরণের সূচনা হয়।

সীমাবদ্ধতা :- বাংলার নবজাগরণের প্রকৃতির সীমাবদ্ধতাই যে সব দিক গুলি দায়ী করা যায় সেগুলি হল যথা —

 1) বাংলার নবজাগরণ ছিল সীমাবদ্ধ নবজাগরণ। এই নবজাগরণ কেবলমাত্র সমাজের উচ্চ শ্রেণীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
 
 2) বাংলার নবজাগরণে হিন্দু সমাজের বৃহত্তর নিম্নবর্গের মানুষ। কৃষক সমাজ ও মুসলিম সমাজের সাথে নবজাগরণের কোন সম্পর্ক ছিল না। এই জন্য ডঃ অনিল শীল একে এলিটস আন্দোলন বলে অভিহিত করেন।
 
 3) কলকাতা কেন্দ্রিক বাংলার নবজাগরণের সময় কলকাতা ও বাংলা ছিল ব্রিটিশ এর কাছে পরাধীন। তাই এই আন্দোলন এর ব্যাপকতা ও বিশালতা খুব একটা সুপ্রসর ছিল না।

 4) বাংলা নবজাগরণ এর প্রেক্ষাপট এক রূপ প্রকৃতির ছিল বলে ডঃ অমলেশ ত্রিপাঠী মনে করেন এই এক রূপ হওয়ার জন্য বাংলার নবজাগরণ শুধুমাত্র একটা শ্রেণীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।

 5) বাংলার নবজাগরণে ইতালির নবজাগরণের মত গতিবেগ,উদ্যম ও বহুমুখী সৃজনশীলতা লক্ষ্য করা যায়নি। যার ফলে এই আন্দোলন সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও কিছু ঐতিহাসিক এর মতে এটি বাংলার প্রকৃত নবজাগরণ নামে অভিহিত।

10. অসহযোগ আন্দোলনের পটভূমি আলোচনা করো।

ভূমিকা :- ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে একটি উজ্জ্বল দিকচিহ্ন হল 1920-1921 সালের অহিংস আন্দোলন। ব্রিটিশ সরকারের সাথে সব রকম ভাবে অসহযোগিতা করা এবং তার মাধ্যমে সরকারকে সমস্ত ভাবে দুর্বল করে তাকে ভারতের হাতে স্বাধীনতা অর্পণে বাধ্য করা হলো এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য। এই আন্দোলনের পুরোহিত ছিলেন মহতমা গান্ধী এবং তার নেতৃত্বে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন সারা ভারতে উজ্জ্বল রূপ ধারণ করেছিল।

     1920 সালের 4 ঠা সেপ্টেম্বর তারিখে কলকাতায় কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশন বসে। গান্ধীজী এই অধিবেশনে অহিংস আন্দোলনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। কিন্তু এই প্রস্তাবে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ,অ্যানি বেসান্ত,চিত্তরঞ্জন দাস, মদনমোহন মালব্য প্রমুখ নেতার সম্মতি ছিল না। কিন্তু ভোটাভুটিতে গান্ধীজীর প্রস্তাবটি জয়যুক্ত হয় এবং আন্দোলনের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়।

      গান্ধীজীর অসাধারণ সংগঠন,প্রতিভা ও নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনকে সমগ্র ভারতে প্রসারিত করার দুটি কর্মসূচি ছিল। যেমন —(১) গঠনমূলক কর্মসূচি,(২) বর্জন মূলক কর্মসূচি। গঠনমূলক কর্মসূচির দিক থেকে প্রধান কাজ গুলি হল অস্পর্শতা দূরীকরণ,হিন্দু-মুসলমানের মিলন, মদ্যপান নিবারণ,দেশি সুতার বস্ত্র বয়ন এবং তিলকের নামাঙ্কিত তহবিলের জন্য এক কোটি টাকা সংগ্রহ।

      অন্যদিকে,অসহযোগ আন্দোলনের স্বপক্ষে বর্জন মূলক কর্মসূচির মধ্যে ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বর্জন,আদালত বর্জন,আইন সভা বর্জন,সরকারি অনুষ্ঠান বর্জন প্রভৃতি ছিল গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি। সঙ্গে সঙ্গে এই আন্দোলনের বর্জন মূলক কর্মসূচির অপর একটি দিক হলো বিদেশি পোশাক বর্জন এবং স্বদেশী পোশাক গ্রহণ।

অহিংস অসহযোগ আন্দোলনকে জোরদার করে তোলার জন্য গান্ধীজী 1920 সালের 7 ই মার্চ তারিখে সবরমতী আশ্রম থেকে প্রচারিত একটি ইশতেহারে এই আন্দোলনকে খিলাফত আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করে। সেই সময় খিলাফত আন্দোলনকে দমন করার জন্য ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাপক হিংসা প্রয়োগ করা হয়েছিল। আর প্রতিকারের উদ্দেশ্যে তিনি অসহযোগ আন্দোলনকে একটি তীক্ষ্ণ আন্দোলন হিসেবে গড়ে তোলেন এবং সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকারকে মানসিকভাবে বিপন্ন করার জন্য অসহযোগ আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করেন

      গান্ধীজীর আহবানে সাড়া দিয়ে উকিল, ব্যারিস্টার,আদালত বর্জন করে আইনসভার সদস্য গন আইনসভা ত্যাগ করেন এবং ছাত্র ছাত্রীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ত্যাগ করে। গান্ধীজীর আহবানে উদ্বুদ্ধ হয়ে সারা দেশের মানুষ বিলাতি দ্রব্য বর্জন ও পুড়িয়ে ফেলতে শুরু করে। গান্ধীজীর নেতৃত্বে জাতীয় কংগ্রেসের উদ্যোগে অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে স্বদেশী শিক্ষা শুরু হয়। এই উদ্দেশ্যে কাশিতে কাশি বিদ্যাপীঠ, গুজরাটে গুজরাট বিদ্যাপীঠ এবং বাংলাতে বেঙ্গল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গরে উঠতে সাহায্য করেন।

      কিন্তু ঠিক এই সময়ে উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুর জেলার চৌরিচৌরা গ্রামে কৃষকের ওপর পুলিশের যথেষ্ট গুলি চালনায় বিক্ষিপ্ত কৃষকরা চৌরিচৌরা থানায় আগুন লাগিয়ে 22 জন পুলিশ কর্মী নিহত করেন। এই ঘটনায় অহিংস নীতির পূজারী গান্ধীজি অত্যন্ত ব্যথিত হন এবং আন্দোলন প্রত্যাহার করার নির্দেশ দেন। তাঁর নির্দেশ এর ফলে অহিংসা ও অসহযোগ আন্দোলন উত্তেজনাময় অবস্থার অকাল মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। তাই জহরলাল নেহেরু দুঃখ করে বলেন যে ‘একটি ক্ষুদ্র এলাকায় অতিক্ষুদ্র সংখ্যক মানুষের পাশে গান্ধীজী সকল দেশবাসীকে শাস্তি দিলেন।’

উপসংহার :- সুতরাং, আমরা দেখতে পাচ্ছি যে অহিংস অসহযোগ আন্দোলনটি তার প্রবল উদ্দীপনাময় ও রোমাঞ্চকর সময় অকাল মৃত্যুর মুখে পতিত হয়েছিল এবং সমস্ত আয়োজন সত্বেও আন্দোলনটি ইসসিত সাফল্যের মুখ দেখতে পাইনি। তবুও আমাদের স্বীকার করতে হয় যে এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা গণচেতনা ও গণমুক্তি স্পৃহা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে চির উজ্জ্বল হয়ে আছে। এখানে নিহত আছে এই আন্দোলনের ঐতিহাসিক তাৎপর্য।

11. আইন অমান্য আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য ও তাৎপর্য আলোচনা করো।

ভূমিকা :- ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে মহাত্মা গান্ধীর প্রচেষ্টায় অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের মতন 1930-34 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত যে অহিংস গণ আন্দোলন সংগঠিত হয় তা প্রাক স্বাধীনতার ইতিহাসের পাতায় আইন অমান্য আন্দোলন নামে পরিচিত। তাই ভারতবাসী রাজনৈতিক জীবনে বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত ও মতাদর্শগত বিরোধকে দূর করে স্বাধীনতা লাভের পথকে প্রসারিত করেছিল এই আইন অমান্য আন্দোলনের পটভূমি।

আইন অমান্য আন্দোলনের কারণ/বৈশিষ্ট্য :-

  আইন অমান্য আন্দোলনের পশ্চাতে যে সমস্ত কারণ বা বৈশিষ্ট্য গুলি আছে সেগুলি হল যথা —

অসহযোগ আন্দোলনের ব্যর্থতা :-  ভারতবাসী বহু আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। কিন্তু কোন ফলাফল আসার আগে গান্ধীজি অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেওয়ায় জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা নিরসনের মধ্যে দিয়ে আন্দোলনটি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ফলে ভারতীয়রা পুনরায় এরকম একটি গণআন্দোলন চেয়েছিল।

কৃষক শ্রেণীর দুরবস্থা :-  বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার ফলে ভারতীয় কৃষক,শ্রমিক ও মধ্যবিত্তের মধ্যে প্রবল অসন্তোষ দেখা দেয়। যার ফলে কাঁচা তুলা,পাঠ,ধান প্রভৃতি পণ্যের মূল্য হ্রাস পেলে বাংলা,বিহার ও উত্তরপ্রদেশের কৃষকের অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং বিভিন্ন ধর্মঘটে সামিল হয়।

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা :-  অসহযোগ আন্দোলন ব্যর্থতার ফলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে হিন্দু-মুসলমানরা একে অপরকে ঘৃণা করতে শুরু করে। যার পরিণতি হিসেবে সাম্প্রদায়িক হানাহানি শুরু হয়। 

শ্রমিক অসন্তোষ :-  বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার ফলে শ্রমিকদের বেতন হ্রাস, ছাঁটাই, লকআউট ইত্যাদি কারণে শ্রমিকদের মনে অসন্তোষ দেখা দেয়। তাই তারা এই ক্ষোভকে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন এইরকম বৃহত্তর আন্দোলনের মাধ্যমে।

আইন অমান্য আন্দোলনের সাফল্য /গুরুত্ব বা তাৎপর্য :-

  অনেক ত্যাগ ও তিতিক্ষার পর আইন অমান্য আন্দোলনের যে সমস্ত ফলাফল লক্ষ্য করা যায়,সেগুলি হল —

 ১) আইন অমান্য আন্দোলনের ফলে ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষ, জাতি,ধর্ম,বর্ণ,শ্রমিক-কৃষক, মধ্যবিত্ত ও পুঁজিপতি সকলে এই আন্দোলনে যোগদান করে।
 ২) ভারতের নারী সমাজ বিপুল সংখ্যায় এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে প্রমাণ করেছিলেন যে ইংরেজ শাসন তাদের কাম্য নয়।
 ৩) এই আন্দোলনের ফলে জাতীয় কংগ্রেসের মর্যাদা বৃদ্ধি পায় এবং সরকার উপলব্ধি করেন কংগ্রেস কে বাদ দিয়ে ভারতীয় সমস্যার সমাধান করা কখনও সম্ভব নয়। 
  ৪) এই আন্দোলনের অভিজ্ঞতা 1942 খ্রিস্টাব্দের ভারত ছাড়ো আন্দোলন কে সফল করে স্বাধীনতার পথ সুপ্রশস্ত করে।

উপসংহার :- পরিশেষে বলা যায় যে অনেক ত্যাগ,তিতিক্ষা ও রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে আইন অমান্য আন্দোলন ইপ্সিত সাফল্যের মুখ দেখতে পেরে ছিল। যা স্বাধীনতা লাভের গণচেতনা ও গণ মুক্তির স্পৃহা স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে চির উজ্জ্বল আছে। এখানেই নিহিত রয়েছে আইন অমান্য আন্দোলনের ঐতিহাসিক তাৎপর্য।


12. ক্রিপস মিশনের প্রস্তাবগুলি কি ছিল ?এই প্রস্তাব গুলি সম্পর্কে ভারতীয়দের কি প্রতিক্রিয়া হয়েছিল ?
অথবা, 
ক্রিপস মিশন কি ? ক্রিপস মিশনের প্রস্তাবগুলি কি ? ক্রিপস প্রস্তাব গুলি ব্যর্থ হয়েছিল কেন ?



ভূমিকা :- ভারতবর্ষের স্বাধীনতা অর্জনের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হল ক্রিপস মিশন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ভারতের সমর্থন পাওয়ার আশায় ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন বিষয়ক রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ব্রিটিশ সরকার ক্রিপস মিশনকে ভারতবর্ষে পাঠায়। যদিও এই মিশন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিষয়ে এগিয়ে গিয়ে ভারতকে ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস বা ব্রিটিশ ভুক্ত স্ব-শাসিত এলাকা মর্যাদাদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মাত্র। কিন্তু তবুও ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে এই মিশন ছিল বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ।

    1942 সালে 23 শে মার্চ তারিখে স্যার স্টাফোর্ড ক্রিপস এর নেতৃত্বে ক্রিপস মিশন ভারতে এসে পৌঁছালে ভারতের রাজনৈতিক সমস্যাকে দ্রুত সমাধানের জন্য ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা সম্পর্কে কয়েকটি প্রতিশ্রুতি দেন মাত্র। সেগুলি হল যথা —

 ১) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে ভারতবর্ষকে ব্রিটিশ ভুক্ত ডোমিনিয়ন এর মর্যাদা দেওয়া হবে।
 ২) এই ডোমিনিয়নের অন্তর্গত প্রদেশগুলোকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকার দেওয়া হবে।
 ৩) প্রদেশ গুলির আইনসভা গুলিকে একটি সংবিধান রচনাকারী সংস্থা গঠন করার অধিকার দেওয়া হবে।
 ৪) ভারতের রাজন্যবর্গকে আইনসভার প্রতিনিধি নিয়োগ করার অধিকার দেওয়া হবে।
 ৫) ভবিষ্যতে ডোমিনিয়ন এর সরকার মন্ত্রিসভা পরিচালিত দায়িত্বশীল সরকারে পরিণত হবে।

ক্রিপস মিশনের ব্যর্থতা 


     ক্রিপস মিশনের প্রস্তাবগুলি ব্যর্থ হওয়ার যে সমস্ত দিক গুলি আছে সেগুলি হল —

    ক্রিপস মিশনের প্রস্তাব কংগ্রেস প্রত্যাখ্যান করার পরে কংগ্রেসের নেতা গান্ধীজীর মানসিকতা ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মিস্টার ক্রিপস ভারতের স্বাধীনতা লাভের দাবিকে উপেক্ষা করে ভারতকে ব্রিটিশ ডোমিনিয়ন মর্যাদা দেওয়ার বহু পুরনো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ প্রস্তাবটিকে জোরালোভাবে উত্থাপন করার জন্য গান্ধীজী ক্রিপস মিশনের প্রস্তাবকে কঠোরভাবে সমালোচনা করে এবং এই প্রস্তাবকে তিনি “ধ্বংস মুখ ব্যাংকের নামে ভবিষ্যৎ তারিখের চেক” বলে চিহ্নিত করেছেন। এরকমভাবে গান্ধীজী কর্তৃক ক্রিপস মিশন প্রত্যাখ্যান হলে গোটা কংগ্রেস ক্রিপস মিশনকে প্রত্যাখ্যান করে।

    মুসলিম লীগও ক্রিপস মিশনকে প্রত্যাখ্যান করে কারণ মিস্টার ক্রিপস কংগ্রেসের সাথে আলাপ-আলোচনা করেছিল এই ছিল মুসলিম লীগের অভিযোগ। মিস্টার জিন্না মনে করেছিলেন যে ক্রিপস মিশন ভারতে স্বাধীনতা বিষয়ক রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানে আলোচনায় মুসলিম লীগকে মোটেই গুরুত্ব দেননি। তিনি সরাসরি ক্রিপস মিশনের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ করেন যে মুসলিম লীগকে টেক্কা দিয়ে কংগ্রেসের সাথে বন্ধুত্ব সুলভ আচরণ গড়ে তুলেছিল। এইজন্য ক্রিপস মিশনকে প্রত্যাখ্যান করেছিল মুসলিম লীগ।

উপসংহার :- কিন্তু তবুও আমাদের স্বীকার করতে হয় যে চূড়ান্ত পরিণামে ক্রিপস মিশন ব্যর্থ হয়ে গেলেও এই ব্যর্থতা থেকে ভারতবাসীর মনে স্বাধীনতার চেতনা ও মুক্তির স্পৃহা এই লক্ষ্যে বলিষ্ঠ মুক্তির সংগ্রাম গড়ে তোলার চেতনায় সুদৃঢ় হয়ে ওঠে। আর এর ফলে 1942 সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলন গড়ে ওঠে। এই ভাবেই ক্রিপস মিশন ভারতীয় জনগণের মুক্তির স্পৃহা ও আলোরনময়ী চেতনাকে উদ্দীপিত করে তোলে। এখানেই নিহিত রয়েছে ক্রিপস মিশনের মহিমান্বিত তাৎপর্য।

13. নৌ-বিদ্রোহ সম্পর্কে আলোচনা করো।


ভূমিকা :- ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে একটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা হলো নৌ-বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহের প্রবল আঘাত ব্রিটিশ শক্তিকে ভারতবর্ষ ছেড়ে যেতে বাধ্য করেছিল। তাই 1857 সালের সিপাহী বিদ্রোহকে যদি ভারতের স্বাধীনতার প্রথম যুদ্ধ বলে মনে করা হয়, তাহলে 1946 সালের বিদ্রোহকে ভারতের স্বাধীনতার শেষ যুদ্ধ বলে আমরা চিহ্নিত করতে পারি।


নৌ বিদ্রোহের উৎস

1946 সালের 18 ফেব্রুয়ারি তারিখে নৌ-বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল। এই বিদ্রোহের অন্যতম কারণ ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন নৌবাহিনীর জন্য বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা হয় এই সংগৃহীত সৈন্যগণ আজাধীন ফৌজ এর বিচারের নামে প্রহসনের ঘটনার তারা দারুন ভাবে প্রবাবিত হয়। নৌ-নাবিক ফণীভূষণের মতে ভারতের সমাজতান্ত্রিক দলের সিদ্ধান্ত সেনাবাহিনীর ওপর গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল এবং নৌ সেনাদের বিদ্রোহের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিল। এমত অবস্থায় ‘রয়েল ইন্ডিয়ান নেভির তলোয়ার’ নামক জাহাজ নিম্নমানের খাদ্য ও জাতীয় অবমাননার প্রতিবাদে নৌ-সেনারা 1946 সালের 18 ফেব্রুয়ারি তারিখে ধর্মঘট শুরু করে।

নৌ বিদ্রোহের সূচনা

 নৌবাহিনীর এই ধর্মঘটে 15 হাজার শ্রমিক যোগ দেয়। পরের দিন 19 শে ফেব্রুয়ারি তারিখে নৌ-বিদ্রোহীরা ব্রিটিশ পতাকা নামিয়ে কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ও কমিউনিস্টদের পতাকা উত্তোলন করে। তাদের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল ‘ভারত মাতা জিন্দাবাদ’,‘ইংরেজ ভারতছাড়ো’,‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক’ প্রভৃতি স্লোগান। নৌ বিদ্রোহীরা এস.এন.রয় -কে সভাপতি এবং মানসিংহকে সহ-সভাপতি হিসেবে নিযুক্ত করেন। বোম্বাইয়ের সমস্ত রণতরী এবং বারোটি জাহাজের সমস্ত নাবিক নৌ-বিদ্রোহে যোগ দেয়।


নৌ বিদ্রোহের গতি প্রকৃতি

 ধীরে ধীরে নৌবিদ্রোহ বোম্বাই থেকে মাদ্রাস ও কলকাতা বন্দরের ছড়িয়ে পড়ে। বোম্বাই বন্দর এর সমস্ত জাহাজে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। ব্রিটিশ সরকার বিদ্রোহীদের দমন করার জন্য পদাতিক বাহিনী প্রেরণ করে এর ফলে পদাতিক বাহিনী ও নৌবাহিনীর মধ্যে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। সাত দিনব্যাপী এই যুদ্ধের পর ভারতীয় সেনারা জয়লাভ করে। নৌ সেনাদের জয়লাভে ব্রিটিশ সরকার ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ অ্যাডমিরাল গডফ্রে বোমারু বিমানের চেপে ঘটনাস্থলে এসে বিদ্রোহীদের ধ্বংস করার হুঁশিয়ারি দেন কিন্তু নৌ-সেনারা তাতে ভয় না পেয়ে তাদের আন্দোলনকে বরং আরও জোরদার করতে উদ্যোগী হয়।

    নৌ বিদ্রোহের তাদের বিদ্রোহকে সমর্থন করার জন্য ভারতের সমস্ত রাজনৈতিক দলকে আহ্বান জানান। তাদের আহবানে সাড়া দিয়ে বোম্বাইয়ের কমিউনিস্ট পার্টি ধর্মঘটের ডাক দেয়। এই ধর্মঘটে 23 হাজার শ্রমিক অংশগ্রহণ করে,পুলিশের সাথে জনতার সংঘর্ষ বাধে। এ সময় বিদ্রোহীরা দাবি করেন যে ভারতের আজাধীন ফৌজ এর বিচার স্থগিত রাখতে হবে এবং অন্যদিকে ইন্দোনেশিয়া থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে তারা তাদের বেতন বৃদ্ধির দাবিও তুলে ধরে।


নৌ বিদ্রোহের পরিণতি

 নৌ বিদ্রোহ ক্রমশ বেপরোয়া হয়ে উঠতে থাকলে অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল  নৌবিদ্রোহীদের আত্মসমর্পণের কথা বলেন এবং এই আশ্বাস দেন যে তাদের বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষ থেকে বলপ্রয়োগ মূলক ব্যবস্থা নেওয়া হলে জাতীয় কংগ্রেস তাদের স্বার্থ রক্ষার যথাসাধ্য চেষ্টা করবে। অন্যদিকে গান্ধীজী বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে বিরূপ মন্তব্য করে বলেন যে নৌবাহিনী চাকরি না পোষালে তারা যেন চাকরী ছেড়ে দেয়। এই বক্তব্যে নৌবাহিনী অত্যন্ত ব্যথিত হয় এবং অবশেষে বল্লভ ভাই প্যাটেলের কথায় আশ্বস্ত হয়ে তারা আত্মসমর্পণ করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং বলেন যে ‘আমরা ভারতবাসীর কাছে আত্মসমর্পণ করছে ব্রিটিশদের কাছে নয়।

     নো বিদ্রোহীরা আত্মসমর্পণ করলে ব্রিটিশদের যুদ্ধজাহাজ নৌবাহিনীর জাহাজ গুলিকে ঘিরে ফেলে নৌসেনাদের গ্রেফতার করে এবং তাদের ওপর অকথ্য অত্যাচার চালাতে থাকে। নৌবাহিনীদের নেতা এস.এস খানের পায়ে পাথর বেঁধে তাকে আরব সাগরে ডুবিয়ে হত্যা করা হয়। এর ফলে নৌ বিদ্রোহের করুন পরিসমাপ্তি ঘটে।

উপসংহার :- সুতরাং আমরা বলতে পারি যে নৌবিদ্রোহ ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের মনে মৃত্যুর ঘণ্টাধ্বনি বাজিয়ে দিয়েছিল,ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তিকে কম্পিত করেছিল এবং ব্রিটিশ শক্তিকে ভারত রাজ্য ছেড়ে যেতে মানসিকভাবে বাধ্য করে তুলেছিল। তাই শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার ভারতবর্ষকে স্বাধীনতা দেওয়ার পূর্ব ঘোষিত সময় 1948 সালের জুন মাসের পরিবর্তে 1947 সালের 15 আগস্ট তারিখে কমিয়ে আনতে বাধ্য হয়। এই ঘটনা থেকে ভারতের স্বাধীনতা লাভের ইতিহাসে নৌ বিদ্রোহের সুমহান তাৎপর্য সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।







No comments:

Post a Comment